তৃতীয় শিক্ষকদের কপাল খুলছে
সরকারি নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে দীর্ঘদিন ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন সহস্রাধিক ‘তৃতীয় শিক্ষক’। অথচ এরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেশের সব ডিগ্রি কলেজে বিষয়ভিত্তিক তৃতীয় পদে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক।
তবে নীতিমালা সংশোধন করে চলতি মাসের মধ্যেই তাদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে সরকার। এটি বাস্তবায়ন হলে সারা দেশের সহস্রাধিক কলেজশিক্ষকের কপাল খুলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ ডিগ্রি পাস কোর্সের অনুমোদন ও শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নীতিমালায় পরস্পরবিরোধী তথ্য যু'ক্ত থাকায় বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কলেজগুলোর শিক্ষকরা। দুই প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা।
তথ্য অনুযায়ী, কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্স খোলার শর্ত হিসেবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নীতিমালায় বলেছে, স্নাতক (পাস) কোর্স চালুর জন্য বিষয়ভিত্তিক তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।অন্যান্য শর্তের পাশাপাশি নিয়ম মেনে তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দিলেই ডিগ্রি (পাস) কোর্স চালুর অনুমতি এবং নবায়নের ক্ষেত্রেও এ নিয়ম কঠোরভাবে মানছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় ডিগ্রি (পাস) স্তরে বিষয়ভিত্তিক দুজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলেছে।
এদিকে ২০১৮ সালে নতুন করে জনবল কাঠামো ও এমপিও (মাসিক বেতন আদেশ) নীতিমালা জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেখানে বলা হয়, ডিগ্রি (পাস) কলেজে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ ছাড়াও প্রভাষক/ সহকারী অধ্যাপক (বাংলা) দুজন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি) দুজন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক (তথ্যপ্রযু'ক্তি) দুজন, প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক (ঐচ্ছিক বিষয় চালু থাকলে) দুজন হবে। এসব শিক্ষকই এমপিওভুক্তি পাবেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালায় বৈপরীত্য থাকায় বিপাকে পড়েন শিক্ষকরা। কলেজে ডিগ্রি (পাস) কোর্স অনুমতি নিতে গিয়ে তিনজন করে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বেসরকারি ডিগ্রি কলেজগুলো। এদের মধ্যে দুজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হলেও তৃতীয় জন এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না।
সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষক পরিষদের সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিক ও সাধারণ সম্পাদক রুমানা সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে তাদের এমপিওভুক্ত করার আবেদন করেন।এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এক চিঠি পাঠিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির বিষয়ে মতামত জানতে চান। এরপর থেকে শুরু হয় নীতিমালা সংশোধনের কাজ।
গত বছর ১২ নভেম্বর বেসরকারি স্কুল ও কলেজের এমপিও নীতিমালা এবং জনবল কাঠামো সংশোধনে ১০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের বেসরকারি মাধ্যমিক শাখার অ'তিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশিদকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়।এ ছাড়া কমিটিতে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, এনটিআরসিএ, ঢাকা বোর্ডের কর্মক'র্তারা সদস্য হিসেবে আছেন। বেসরকারি মাধ্যমিক শাখার উপসচিবকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। আর কমিটিতে নন-এমপিও শিক্ষক নেতারাও সদস্য হিসেবে আছেন।
মন্ত্রণালয় তখন ৩০ কর্ম দিবসের মধ্যে এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের সুপারিশ করতে বলেছে কমিটিকে। স্কুল-কলেজের এমপিও নীতিমালা ও জনবল কাঠামো সংস্কারের সুপারিশ করবে এ কমিটি। এরই মধ্যে কমিটি বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৭ জানুয়ারি ভিডিও কনফারেন্স মাধ্যমে আরো একটি বৈঠক করে।জানা গেছে, এমপিওভুক্তির নীতিমালা সংশোধন কমিটি মাউশি অধিদপ্তরের কাছে এরই মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে তৃতীয় শিক্ষকদেরদা’বির যৌক্তিকতা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গছে, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮’ সংশোধনের কাজ এখন শেষপর্যায়ে। শেষ মুহূর্তের পরিমা'র্জন, সংযোজন ও বিয়োজনের কাজ চলছে এখন। শিগগিরই এ নীতিমালা চূড়ান্ত করা হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জানা গেছে। নীতিমালা চূড়ান্ত হলেই নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তির আবেদন আহ্বান করা হবে।সংশোধিত নীতিমালায় প্রথমবারের মতো ডিগ্রি স্তরে দুজনের পরিবর্তে তিনজন শিক্ষক এমপিওভুক্ত হতে যাচ্ছেন। জনবল কাঠামোর মধ্যে না থাকায় ডিগ্রিস্তরের তৃতীয় শিক্ষকরা এতদিন চরম বঞ্চনার শিকার হচ্ছিলেন। সমযোগ্যতা নিয়ে চাকরিতে যোগদান করেও তারা এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলেন না।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামোর নতুন এই সংশোধনীর ফলে সারা দেশের সহস্রাধিক কলেজশিক্ষকের কপাল খুলবে। তারা এমপিওভুক্তির সুযোগ পাবেন। এতদিন তারা বিনা বেতনে অথবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দেওয়া নামমাত্র বেতনে শিক্ষকতা করে আসছিলেন।‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮’ সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অ'তিরিক্ত সচিব মোমিনুর রশীদ আমিন জানান, ডিগ্রিস্তরের তৃতীয় শিক্ষকদের জনবল কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
এ ছাড়া যুগের চাহিদা অনুযায়ী এমপিওভুক্তির নীতিমালায় প্রয়োজনীয় আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন করা হচ্ছে। আগের নীতিমালায় গ্রাম ও শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাসের হার একই চাওয়া হতো। এবার গ্রাম ও শহরের জন্য ভিন্ন পাসের হার নির্ধারণ করা হবে। এ ছাড়া আগের চেয়ে নীতিমালা আরো সহ'জ করা হবে।বাংলাদেশ ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষক পরিষদের সভাপতি আবুবক্কর সিদ্দিক জানান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী যে-কোনো বেসরকারি কলেজে কোনো বিষয়ে ডিগ্রি পড়াতে গেলে কমপক্ষে তিনজন শিক্ষক থাকতে হবে। অনার্স পড়াতে গেলে চারজন শিক্ষক লাগে।
অথচ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ম অনুসারে, একটি বিষয়ে মাত্র দুজন শিক্ষক (উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের জন্য একজন, ডিগ্রিস্তরের জন্য একজন) এমপিওভুক্ত হতে পারেন। এই দুজনের বেতন সরকার থেকে দেওয়া হয়। একই বিষয়ের তৃতীয় শিক্ষকের বেতন-ভাতা কলেজ তহবিল থেকে পরিশোধ করতে হয়।সরকারি এই নিয়মের গ্যাঁড়াকলে পড়ে দেশের সব ডিগ্রি কলেজে বিষয়ভিত্তিক তৃতীয় পদে নিয়োগপ্রাপ্ত এসব শিক্ষক সরকারের এমপিও সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এই শিক্ষকদের ‘তৃতীয় শিক্ষক’ বলা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) থেকে জানা গেছে, ১৯৯৮ সাল থেকে ডিগ্রি পর্যায়ের তৃতীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। ২০১১ সাল পর্যন্ত এসব শিক্ষককে নিয়মিত এমপিওভুক্তি দেওয়া হতো।কিন্তু ২০১১ সালের ১১ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নন-এমপিও শিক্ষকদের নিয়ে এক প্রজ্ঞাপন জারি করে।
এতে বলা হয়, ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ প্রদান এবং জনবল কাঠামো স'ম্পর্কিত নির্দেশিকা ২০১০-এ যা-ই থাকুক না কেন, পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অ'তিরিক্ত শ্রেণি, শাখা/বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে নিযু'ক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বহন করতে হবে। এই প্রজ্ঞাপনের পর থেকে ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকরা আর এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না।